আহলে বাইত (আ.) আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা (আবনা): শাসনতান্ত্রিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত করাবার প্রচেষ্টা চলছে এদেশটির জন্মলগ্ন থেকেই। কিন্তু বারো কোটি জনসংখ্যা অধ্যুসিত বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই হয়ে উঠেছে এ পথের অন্তরায়।
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নকালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে এর চার স্তম্ভের একটি অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে গণ্য করাও হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে শাসনতন্ত্রের পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতার স্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলে তার বদলে ভূমিকায় ‘মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা’কে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে শাসনতান্ত্রিক দিক দিয়ে আল্লাহ বিরোধী কোনো অবস্থান নেয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
তবে কোন ভূমিকা এবং কোন স্তম্ভই তো আসলে সবকিছু নয়। বিশেষ করে আইন একটি সম্পূর্ণ জীবন, সম্পূর্ণ সমাজ কাঠামো এবং সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের মুসলিম পরিচিতি হাজার বছরেরও বেশী সময় থেকে চলে আসছে। সাড়ে পাঁচশ’ বছর মুসলমানরা এখানে সরাসরি রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে।
শাসক ও প্রশাসক ছিল মুসলমানরাই। আইন ও বিচার বিভাগ তাদের হাতেই পরিচালিত হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য ও কৃষি তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। এজন্য আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ তারাই করেছে। সেক্ষেত্রে যে কোনো জটিলতার সমাধান বিচার বিভাগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। তখন বিচার বিভাগ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে আলাদা মর্যাদা লাভ করতো।
মুসলমানদের সমাজে কোনো সামাজিক স্তর বিন্যাস বা ভেদাভেদ প্রথা ছিল না। প্রতিবেশী অমুসলিম সমাজে এটি ছিল এবং এটিকে তারা ধর্মশাসিত বর্ণভেদ প্রথা হিসাবে অব্যাহত রেখে চলছিল। তবুও বর্ধিষ্ণু মুসলিম জনবসতির ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার সুফলের চাপে বাংলা মুলুকের অমুসলিমদের মধ্যকার বর্ণভেদ ও অচ্ছুতবাদের মধ্যে উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় অপেক্ষাকৃত বরং অনেক বেশী শিথিলতা দেখা যায়।
এ শিথিলতা মুসলমানদের সমাজে ইসলামী আইনের যৎসামান্য হলেও সার্থক প্রয়োগেরই প্রমাণ। তারপর দিল্লীর শাসক শেরশাহের সংক্ষিপ্ত শাসনামলের পাঁচ বছরে জমি জরীপ এবং জমি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সংক্রান্ত যাবতীয় যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও তার প্রয়োগ ইসলামী আইনের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার ফলেই সম্ভবপর হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে আজো এটি অনুসরণীয় হয়ে রয়েছে।
বাংলা তখন দিল্লীর সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিল। এর অব্যহিত পূর্বে শেরশাহ বাংলারই শাসক ছিলেন। সবশেষে সতের শতকের শেষের দিকে দিল্লীর শাসক বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের শাসনামলে ফতওয়া-ই-আলমগীরী নামে যখন ইসলামী আইনের সর্বশেষ সংকলন রচিত হয় এবং তার ভিত্তিতে সমগ্র মোগল ভারতের শাসনকার্য পরিচালিত হতে থাকে তখন সুবে বাঙ্গালা দিল্লীরই অধীন ছিল এবং এই ইসলামী আইন ও শাসনের সুফল বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
ইংরেজদের আসার পর থেকে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে ইংরেজরাই এখানে বিতর্কিত করে তুলেছে নিজেদের স্বার্থে। ইসলামী আইন রোমান বা বৃটিশ আইন থেকে মোটেই হীনতর নয় তা ইংরেজরা খুব ভালো করেই জানতো।
কারণ বারোশ’ বছর ধরে ইসলামী আইনে ডেভলপমেন্ট হয়েছে এবং এ ডেভলপমেন্টটা এক জায়গায় নয়, একদেশে নয়, এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের হাজার হাজার কিলোমিটারব্যাপী বিভিন্ন প্রকারের ও বিচিত্র প্রকৃতির জনবসতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এর সকল শাখা-প্রশাখা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক ছিল না যে দিকে ইসলামী আইন দৃষ্টি দেয়নি এবং আল্লাহ ও রসূলের প্রদত্ত ভারসাম্যপূর্ণ মূলনীতির ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে সুষম, সামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রকৃতিজাত স্বাভাবিক বিধান প্রণয়ন করেনি।
ইসলামী আইনকে কুরআনে এক কথায় ‘আদল’ বলা হয়েছে। এর মূল ভাবধারাই হচ্ছে মানুষের মধ্যে আদল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। ইংরেজ শাসকরা এ বিষয়টি ভালো করেই জানতো।
সত্যি বলতে কি বিশ শতকের এই শেষার্ধ পর্যন্ত বৃটিশ আইন ও জাতিসংঘের ভিত্তিতে পাশ্চাত্যের আইনের মধ্যে যেসব মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার কোনোটিই ইসলামী আইনের ডেভলপমেন্টের আওতার বাইরে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে মনে হবে সেখান থেকেই সেগুলি চয়ন করা হয়েছে।
শুধুমাত্র মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়টি নিলেই আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী আইন তার প্রথম প্রবর্তন যুগে একজন মানুষকে যে মৌলিক মানবাধিকার দিয়েছিল পাশ্চাত্য আইনে তা লাভ করতে চৌদ্দশ’ বছরের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে এবং এরপর এখনো তা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।
ইসলামী আইনের প্রথম শাসক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদা ও কালোর পার্থক্যকে তাঁর দুই পায়ের তলায় দাবিয়ে দিয়েছিলেন। আজো তার জেগে ওঠার সম্ভাবনা কোথাও কোনো মুসলমান সমাজে নেই।
আমরা বলতে চাই আজ থেকে আড়াইশ’ বছর আগে ইংরেজ শাসকরা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। নয় তো ইসলামী আইনের মধ্যে আসলে কোনো গলদ দেখা হয়নি।
ইসলামী আইন আমাদের জীবন সমস্যা সমাধানে অপারগ ও ব্যর্থ হচ্ছে এমন কোনো বিষয় প্রমাণিত হয়নি। হাঁ, ইসলামী আইনের গতিশীল ব্যবস্থাপনার একটি বিশিষ্ট ধারা ও পদ্ধতি আছে। এ ধারা ও পদ্ধতির মূল শক্তি হচ্ছে ইজতিহাদ।
ইংরেজ শাসনের বেশ কিছুকাল পূর্ব থেকেই এ পদ্ধতির মধ্যে শৈথিল্য দেখা দেয় এবং ইজতিহাদের ধারা মৃতপ্রায় ও বিশুষ্ক হয়ে পড়ে। মুসলমানদের এই মৃতপ্রায় অবস্থা অর্থাৎ ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার বন্ধ্যাত্ব ইংরেজ শাসকদের সাহায্য করে।
এ ছাড়া অন্য কোন কারণ নেই। আর তখন কেবল বাংলার বা উপমহাদেশের নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমানদের ওপর একপ্রকার নির্জীবতা ছেয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ধীরে ধীরে কয়েকশ’ বছর ধরে মুসলমানরা এর শিকার হয়েছিল এবং এখনো এ অবস্থা কমবেশী অব্যাহত আছে।
ইসলামের মধ্যে কোনো গলদ প্রবেশের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। অথবা দীর্ঘ পথ শ্রমে ইসলাম পরিশ্রান্ত শক্তিহীন হয়ে পড়েনি। বরং ইসলামের মূল শক্তিকেন্দ্রে শক্তির ভা-ারকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে, সেখানে যতই চাপ দেয়া হবে শক্তির বিচ্ছুরণ ততই বৃদ্ধি পাবে।
এই মূল কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে দুটো শক্তির আধার ঃ একটি আল্লাহর কিতাব এবং অন্যটি রসূলের সুন্নাত। আল্লাহ দিয়েছেন মূলনীতি এবং রসূল তার ব্যাখ্যাতা ও প্রয়োগকারী এবং এই সঙ্গে তার শিক্ষকও। রসূল (স) নিজেই বলেছেন ঃ ‘বুঈস্তু মুআল্লিমান’ অর্থাৎ আমাকে শিক্ষক করে পাঠানো হয়েছে।
তাই আল্লাহর দেয়া মূলনীতির ব্যাপারে কোনো অভাব দেখা দেয়নি। রসূলের পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা অনন্তকাল পর্যন্ত ইসলামী আইন প্রণয়নে আদর্শ ও মডেল হিসাবে বিরাজ করবে। “লাকাদ কানা লাকুম ফী রসূলিল্লাহে উস্ওয়াতুন হাসানা” অর্থাৎ তোমাদের জন্য রেখেছি আমি আল্লাহর রসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ।
আমাদের এ আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইংরেজের শাসনের পূর্ববর্তীকাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমানরা তাদের নিজেদের আইন দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে। সে আইনের একটা নিজস্ব চরিত্র, স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট আছে। বাংলার মুসলমানদের সমাজ ও পরিবেশের সাথে তার পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে।
বিগত আড়াইশ’ বছরের বৃটিশ আইনের শাসন মুসলমানদের সমাজ-রাষ্ট্র পরিবেশে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেনদেনে, নৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে সর্বত্রই একপ্রকার বিশৃংখলা ও অরাজকতার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষ করে ইংরেজদের বিদায়ের পরও যখন আমরা ইংরেজের দেয়া আইনকে মাথায় করে রাখি তখন আমাদের নিঃস্বতা ও দারিদ্রসীমা ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ছয় মাসের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণীত হলেও আজ পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি আইনের শাসনে ফিরে যেতে পারিনি।
দেশের আইন আছে আদালতে। কিন্তু এমন কোনো কাজ নেই যা আইন এড়িয়ে বরং আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে স্বচ্ছন্দে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে, মানুষ আইন মানছে না।
তাহলেও তো আইনের ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে, এ আইনের মধ্যে মানুষের চরিত্র গঠন করার কোনো বিষয় নেই। বুঝা যাচ্ছে, মানুষের সার্বিক জীবনের ওপর এ আইনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অবস্থা কেবল বাংলাদেশে নয়, এ পাশ্চাত্য আইন দুনিয়ার যে দেশেই প্রবর্তিত হয়েছে সেখানেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এ ধরনের ধস নেমেছে।
ইসলামী আইনে সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহকে এবং এ আইনে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মানুষকে। কাজেই এ আইন ব্যবস্থার আওতায় মানুষের এ ধরনের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ আজ এক চরম আইনগত মাৎসন্যায়ের মধ্যে অবস্থান করছে। আইন আছে কিন্তু আইনের শাসন নেই। মনে হচ্ছে আইন অপারগ। আইনের ফাঁক দিয়ে আইন প্রয়োগকারীর হাত দিয়ে অনেক কিছুই বের হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্য দিয়ে কেবল শাসকের নয়, আইনেরও দুর্বলতা ফুটে উঠছে। এ আইন জাতির নৈতিক বৃত্তিকে প্রবল করতে পারছে না। আর আইনের শাসনের জন্য নৈতিক বৃত্তির সমর্থনেরও প্রয়োজন। ফলে এ আইন ব্যর্থ হচ্ছে।
আজ দেশের সকল আইনবিদকে অবশ্যই একথা ভেবে দেখতে হবে। বোকার স্বর্গে বাস করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের কঠিন কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
একমাত্র ইসলামী আইন একদিকে জাতির নৈতিক পরিগঠন সহকারে তার মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করতে পারে। ইসলামী আইন একটি গতিশীল সংস্থা। জীবনকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার তার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
আমাদের দেশে এই আইনের পুনরুজ্জীবনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তবেই দেশ ও জাতি তার বর্তমান সংকট উত্তরণে সক্ষম হবে।
লেখক: মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান।
Your Comment